ঘুরে আসু
ন মূর্তি-লেপচাজগত-দার্জিলিং
ভ্রমণসূচী অনুযাযী চতুর্থ দিন ২৬ মার্চ সকালে জলখাবারের পর মূর্তিকে বিদায় জানিয়ে আমাদের নিয়ে রাজুর গাড়ি মালবাজার ওদলাবাড়ি সেবক করোনেশন ব্রিজ পেরিয়ে এগিয়ে চললো চেনা সেই পথে। কালিঝোরা বাজারের আগে চা পানের বিরতি তার পর কিছুটা এগিয়ে রম্ভি-ঝোরার পাশ দিয়ে মংপু যাওয়ার রাস্তা। সেই পথেই জোড়বাংলো ঘুম হয়ে লেপচাজগত এর BROADWAY HOME STAY তে পৌঁছলাম বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ। গাড়ির দরজা খুলতেই কনকনে ঠান্ডায় শুরু হলো দাঁতের ঠকঠকানি। হাতের কাছে রাখা শীতবস্ত্রে আচ্ছাদিত হয়েও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। SWIFT D’ZIRE এর মালিক তথা চালক রাজু্র প্রাপ্য মিটিয়ে দু পা হেঁটে হোম স্টের ভেতরে গিয়ে কিছুটা স্বস্তি হলো যেন। ভোর রাতে বৃষ্টির জন্য বাইরে তাপাঙ্ক নয় দশে ঘোরা ফেরা করছে। ধূমায়িত কফি কাপ হাতে হোম’স্টের ছোট্ট ছাদে রঙীন ছাতার নীচে বসে বাতাসে ভেসে আসা মেঘেদের লুকোচুরি খেলা দেখতে বেশ লাগছিল। BROADWAY HOME STAY এর সাথে যোগাযোগ হয়েছিল সুখিয়াপোখরির আগে মিম চা বাগান লাগোয়া গ্রামের গাড়ির মালিক তথা চালক সঞ্জীবের মাধ্যমে [ফোনঃ 9733790881] ওর নিকট আত্মীয় BROADWAY HOME STAY’র মালিক NARESH DAWA LA [ফোনঃ7477888858] অতীব সজ্জন এবং নিপাট ভদ্রলোক। নিজেই আমাদের রুমে নিয়ে গেলেন এবং হাতজোড় করে জানালেন উনি জরুরী কাজে দুদিনের জন্য মিরিক যাচ্ছেন তবে আমাদের যাতে কোন রকম অসুবিধা না হয় সেই বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। সকালে বেড টি, জল খাবার, দুপুরে লাঞ্চ বিকেলে পাকোড়া চা/কফি রাতে নন-ভেজ ডিনার [চিকেন] এই হিসাবে মাথাপিছু থাকা খাওয়া দিনপ্রতি খরচ ১৩০০টাকা। সঞ্জীব আমাদের সেটা ১১০০টাকায় রফা করে দিয়েছিল। একটি ঘরে চার জন থাকার ব্যবস্থা থাকলেও আমরা আলাদ দুটো ঘরে থেকেছি। যাওয়ার আগে নরেশজী আবারও হোম’স্টের পাচক অমিত ছেত্রীকে বলে গেলেন নির্ধারিত খাবার/আইটেম এর বাইরে আমাদের পচ্ছন্দের খাবার চাইলে সেটা যেন করে দেওয়া হয়।
রুমে সেট্ল হয়ে গরম পোশাকে শরীর এবং কান মাথা ঢেকে বাইরে এলাম। মথার ওপর দিয়ে আবার কখনও বা শরীর ছুঁয়ে উড়ে চলেছে জলকনা মিশ্রিত মেঘের দল। হোম’স্টের ঠিক আগের একটি গেস্টহাউস কাম হোমস্টেতে চলছে বিয়ে বাড়ির ধামাকা। চটুল গানের সাথে রাস্তার ওপর পানীয়ের গ্লাস হাতে অতিথিদের নাচ। সামনের পাইন বনবীথিতে ওঠার সময় দেখছি ওপর থেকে পুরুষ মহিলা সপরিবারে বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে নেমে আসছেন। প্রায় সবার হাতেই কিছু না কিছু উপহার। নেপালীদের বিয়েতে দারুণ একটি প্রথা চালু আছে। বিয়ের অনুষ্ঠান স্থলে ঢোকার আগে বাইরে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে থাকে পাত্র অথবা পাত্রী পক্ষের প্রতিনিধি। তাদের কাছে খাতা, সেখানে আমন্ত্রিতদের পরিবার ভিত্তিক নামের তালিকা। আমন্ত্রিতরা এসে সেখানে যার যেমন সামর্থ সেই মত টাকা দিয়ে তার পর বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন। দুপুরে হোমস্টেতে খেতে বসে পাচক অমিত ছেত্রীর কাছে বিষয়টা বিস্তারিত ভাবে জানলাম। উপহারের সাথে নগদ অর্থ দানের এই প্রচলিত রীতি নেপালী জনজাতির বিয়ের অন্যতম পরম্পরা যাতে আপ্যায়ন এবং পানভোজন বাবদ পাত্র-পাত্রী উভয় পক্ষেরই কিছুটা আর্থিক সুরাহা হয়। লেপচাজগতে গুটিকয়েক পোশাক সামগ্রী/চায়ের দোকান ছাড়া কিছু নেই। বাজার করতে যেতে হয় ৬কিলোমিটার দূরের সুখিয়াপোখরি যেখানে সব কিছুই সহজলভ্য। সকালেই আগে থেকে পছন্দের খাবার বলে দিতে হয়। যেমন সেদিন দুপুরে BROADWAY HOME STAY’র কুক অমিত ছেত্রীর রান্না ডাল বেগুন ভাজা সবজি এবং ধূমায়িত ভাতে ফুল কপি দিয়ে রুই মাছের কোন জবাব নেই। অমিতের হাতের রান্নার স্বাদ নিতে অন্য গেস্ট হাউসের অতিথিরাও আসেন। BROADWAY HOME STAY’র সামান্য আগে টিলার ওপর সুউচ্চ পাইন গাছের সারি। একেবারে উপরে ভিউ পয়েন্ট। আকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা খুব ভালো দেখা যায়। সেদিন বিকেলে কিছুক্ষণ পাইন গাছের নীচে বিচরণ এবং ফটো শ্যুটের মাঝেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি সাথে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। পরিমরি করে হোমস্টের রুমে ঢুকতে বাধ্য হলাম। গরমাগরম পাকোড়া আর কফি পানে শরীরে কিছুটা আমেজ এল। লেপচাজগতে ঠান্ডার আধিক্য এবং বিরামহীন জলজ মেঘের আসা যাওয়ার দরুণ সব সময় একটা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব।
যাত্রার পঞ্চম দিন ২৭মার্চ সকাল থেকেই প্রকৃতি মেঘাচ্ছন্ন। সকালে ব্রেকফাস্টের পর সঞ্জীবের WAGON’R গাড়িতে প্রথমে গেলাম পাইন ভিউ শ্যুটিং পয়েন্ট। সেখান থেকে সুখিয়াপোখরি হয়ে সীমানা ভিউ পয়েন্টে কিছু সময়ের বিরতি। বিপরীত দিকের পাহাড়ে মানেভঞ্জন, যেখান থেকে আরও উপরে সান্দাকফু যাওয়ার রাস্তা। তবে মেঘলা প্রকৃতির জন্য দূরের পাহাড়ী দৃশ্য খুব ভালো উপভোগ করা যায় নি। পরবর্তী গন্তব্য মিরিকগামী পথে প্রতিবেশি রাজ্য নেপাল সীমানা, সেখানে চেকপোস্ট পার হয়ে পশুপতিনগর। পায়ে পায়ে ঘোরা গেলেও ওখানে আলাদা গাড়িতে আসা যাওয়ার ব্যাবস্থা আছে। বছর পঁচিশ আগে একবার মিরিক থেকে দার্জিলিং ফেরার পথে পশুপতিনগর এসেছিলাম। সময়ের সাথে সাথে বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই। নির্মিত হয়েছে কাঠমান্ডুর পশুপতি নাথ মন্দিরের মিনি সংস্করণ। আশেপাশের দোকানপাট বেশ কিছু ভারতীয়দের দখলে। তবে কতিপয় কসমেটিক্স সামগ্রী ছাড়া দরদামে বিশেষ ফারাক নেই। কিছু সময় সেখানে কাটিয়ে আগের রাস্তা ধরেই সীমানা ভিউ পয়েন্ট থেকে পৃথক রাস্তায় চলে এলাম জোরপোখরি। ২০০৭ এ তিনচুলে থেকে ফেরার পথে একরাত এখানে ছিলাম। লেক এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আগের মতোই আছে। একটি রেস্তোরা কাম হোমস্টে এবং দুর্গামাতার মন্দির নতুন হয়েছে। ঠান্ডার প্রকোপ একটু বেশি হলেও নির্জন মনোরম প্রকৃতির কোলে দল বেঁধে একটা দিন খুবই উপভোগ্য। সুখিয়াপোখরিতে প্র্য়োজনীয় কিছু কেনাকাটা করে বেলা তিনটে নাগাদ ফিরে এলাম লেপচাজগত। ডাইনিং টেবিলে অমিত ছেত্রী তখন সাজিয়ে দিয়েছে হট নুডুলস উইথ চিকেন স্লাইস, স্যালাড এবং ওমলেট। খিদের পেটে সেই খাবার ছিল অমৃত সমান। এর পর সন্ধ্যায় পাকোড়া কফি এবং রাতে চিকেন মিলের সাথে লেপচাজগতে দ্বিতীয় দিনের ভ্রমণ সূচী সাঙ্গ হলো।
২৮ এবং ২৯ মার্চ আমাদের সফরের শেষ দু দিন বরাদ্দ ছিল দার্জিলিং এর জন্য। সেই মতো ২৮তারিখ সকালে BROADWAY HOME STAY থেকে জলখাবারের পর সঞ্জীবের পাঠানো TATA SUMO চড়ে দার্জিলিং পৌঁছলাম বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ। দার্জিলিং এ আমাদের দুদিনের অবস্থান ম্যালের ওপরে [BELLE VUE HOTEL] গত ডিসেম্বরে এখানেই ছিলাম। অনবদ্য লোকেশন। ম্যাল ফেসিং রুম হলে তো কথাই নেই। মেঘ মুক্ত আকাশ থাকলে রুমের জানালা অথবা হোটেলের ছাদ থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় খুব সুন্দর। ২০২১ ডিসেম্বরে ঠিক যেমন দেখেছিলাম। মার্চ মাসে কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পাওয়া যাবে না এটা জানা ছিল। তাই পায়ে পায়ে ঘোরা এবং ম্যালে বসে আড্ডা, সন্ধ্যায় ইলেকট্রনিক বোর্ডে রঙবাহারী নানাবিধ নাচ গানের অনুষ্ঠান; বাচ্চাদের পনির পিঠে চড়ে মজা উপভোগ আর ম্যালের বেঞ্চে বসে চা কফির সাথে টুকটাক মুখ চালানো এই ছিল আমাদের প্ল্যান। কিন্তু ভানু ভবন থেকে ম্যালের দিকে এগোতেই সব চৌপাট হয়ে গেল। দার্জিলিং ম্যাল পুরোটাই চলে গিয়েছে রাজ্য প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে। সেখানে সরকারী অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে। কাঠ, বাঁশ, লোহার পিলারের ওপর আচ্ছাদন এবং অস্থায়ী সুবিশাল মঞ্চ ইত্যাদি নির্মাণের আড়ালে হারিয়ে গিয়েছে দার্জিলিং ম্যালের চেনা ছবি। নিমেষেই ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল মনটা শ্যালিকা এবং ভায়রা-ভাইয়ের কথা ভেবে। এবার নিয়ে আমাদের পাঁচ বার দার্জিলিং হয়ে গেল কিন্তু ওদের আবার আসার সুযোগ হবে কিনা ঠিক নেই। রাজ্যের অভিভাবিকা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর ৫দিন দার্জিলিং এ অবস্থান হেতু প্রশাসন সর্বদা তটস্থ এবং সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। তথাপি প্রয়োজনীয় কিছু রাস্তায় যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা এবং অন্যান্য কঠোর বিধিনিষেধ মানতে গিয়ে পর্যটকরা বেড়ানোর আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। দার্জিলিং এ থাকার মধ্যে এবার ছিল টয় ট্রেনে জয়-রাইড। গ্লেনারিস আর কেভেন্টার্সে ভোজন এবং টু্কটাক কেনাকাটা। ৩০ মার্চ ভোর থেকেই আকাশের মুখ ভার সাথে বৃষ্টির টিপ-টিপানি। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেলা দশটা নাগাদ রওনা দিলাম বাগডোগরা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। বিকেলের ফ্লাইটে কলকাতা এয়ারপোর্টে অবতরণ। গাঢ় সন্ধ্যায় ঢুকলাম সুখী গৃহকোনে।
0 মন্তব্যসমূহ